২৭৩ কোটি টাকার ভৈরব নদ খনন শেষ হওয়ার আগেই ভরাট

নিউজটি শেয়ার লাইক দিন

যন্ত্রপাতি অভিজ্ঞতা কিছুই নেই

২৭৩ কোটি টাকার ভৈরব নদ খনন শেষ হওয়ার আগেই ভরাট
তরিকুল ইসলাম মিঠু,যশোর: নদী খননের আধুনিক যন্ত্রপাতি বা এ ধরণের কাজে অভিজ্ঞতা দক্ষ জনবল কোনটিই নেই। তার পরে ২৭২ কোটি ৮১ লাখ টাকার বড় প্রকল্পের কাজ পেয়েছেন তারা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে যন্ত্রপাতি ভাড়া নিয়ে দায় সারাভাবে ইতোমধ্যে কাজের প্রায় ৮০ শতাংশ শেষও হয়েছে। তবে বিধিবাম শেষ হওয়া অধিকাংশ এলাকার নদ আবারো ভরাট ও হয়ে গেছে। সে সব খননকৃত নদে আবারও জলজ উদ্ভিদ জন্মে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।

যশোরে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভৈরব নদটি যশোরের চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুর থেকে উৎপন্ন হয়ে যশোর শহরের বুক চিরে বাঘারপাড়া ও অভয়নগর হয়ে খুলনার রূপসা নদীতে গিয়ে মিলেছে। ভৈরব নদের অববাহিকার মানুষের কৃষি, মৎস্য, যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে নদটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা নদের পবাহের সঙ্গে ভৈরব নদের পবাহের যোগসূত্র রয়েছে। অনেক দিন আগেই চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলা থেকে যশোরের চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুর পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটারের মাথাভাঙ্গা নদীটি ভরাট হয়ে যায়। এর ফলে ভৈরব নদের উৎসে পানির পবাহ বন্ধ হয়ে যায়। জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি জমে ভৈরব নদের যশোর অংশে নাব্যতা বিলিন হয়ে যায়। নদ ভরাট হয়ে রুপান্তিরত হয় খালে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস উদ্বোধনের সময় নদের নাব্যতা ফিরিয়ে নৌ-যোগাযোগের ব্যবস্থা করার জন্য ভৈরব নদ খননের পতিশ্রুতি দেন। ২০১৩ সালে নদের নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ শেষ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতিতে যশোরের ভৈরব নদ খনন ও পানি ব্যবস্থাপনা পকল্পের জন্য ২৭২ কোটি ৮১ লাখ টাকা অনুমোদন দেন। গত ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট একনেকের সভায় পকল্পটি পাস হয়। কিন্তু পকল্পের সফলতা নিয়ে প্রথম থেকে এ অঞ্চালের মানুষের মাঝে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৫ জন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ৩৮টি লটে এ বৃহত্তর পরিসরের এ নদ খননের কাজ পায়।
যশোর মুজিব সড়কে অবস্থিত এসটি ইন্টারন্যাশনাল নামের প্রতিষ্ঠানটি পায় দু’টি লটের কাজ। একটি ভবন মেরামতও রক্ষনাবেক্ষণ অন্যটি পায় দু’কিলোমিটার নদ পুনঃখনন। ঢাকা মতিঝিলের সেনাকল্যান ভবনে অবস্থিত ডলিকন্সট্রাকশন লিঃ- এসএ-এস আই জেভী) নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৩ টি লটে পায় ৭ কিলোমিটার পুনঃনদ খনন। যশোর পুরাতন কসবা মিশন পাড়া এলাকার নুর হোসেন নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৪টি লটে পায় ১২ কিলোমিটার পুনঃনদ খননের কাজ পায়। যশোর পুরাতন কসবা মিশন পাড়া এলাকার এস এ-এমএসএ-এনএইচ(জেভী) নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ১টি লটে পায় ৪ কিলোমিটার পুনঃনদী খননের কাজ পায়। যশোর পুরাতন কসবা মিশন পাড়া এলাকার এনএইচ-এমএসসি-এস এ ইউ (জেভী) নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৮টি লটে পায় ২৮.৫০০ কিলোমিটার পুনঃনদ খননের কাজ পায়। যশোর পুরাতন কসবা মিশন পাড়া এলাকার টেকনিপ কর্পোরেশন নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ১টি লটে পায় ৩ কিলোমিটার পুনঃনদ খননের কাজ পায়। যশোর পুরাতন কসবা মিশন পাড়া এলাকার কপোতাক্ষী এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৪টি লটে পায় ১১ কিলোমিটার পুনঃনদ খননের কাজ পায়। যশোর পুরাতন কসবা বিবি রোড এলাকার রেজা এন্ট্রারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ১টি লটে পায় ৩ কিলোমিটার পুনঃনদ খননের কাজ পায়। এসএস এবং এম টি (জেভী) নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ২টি লটে পায় ৫ কিলোমিটার পুনঃনদ খননের কাজ পায়। যশোর পুরাতন কসবা ১৯২ কাজী পাড়া এলাকার শামিম চাকলাদার নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৩টি লটে পায় ৯ কিলোমিটার পুনঃনদ খননের কাজ পায়। যশোর পুরাতন কসবা মিশন পাড়া এলাকার এম টি এন্ড এস এস কনসোর্টিয়াম নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ২টি লটে পায় ৬ কিলোমিটার পুনঃনদ খননের কাজ পায়। সাতক্ষীরার ইটাগাছা এলাকার শেখ আশরাফ উদ্দিন নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ১টি লটে পায় ২ কিলোমিটার পুনঃনদ খননের কাজ পায়। খুলনা ক্রস রোড-২,৩৭ দক্ষিণ টুটপাড়া এলাকার শামিম আহসান নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৩টি লটে পায় ৭.৫০০ কিলোমিটার পুনঃনদ খননের কাজ পায়। খুলনা ১৮ গগন বাবু রোড ( ২য় লেন) এলাকার আমিন এন্ড কোং নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৩টি লটে পায় ১০ কিলোমিটার পুনঃনদ খননের কাজ পায়। চুয়াডাঙ্গা জীবন নগরের জাকাউল্লাহ এন্ড ব্রাদার্স নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ১টি লটে পায় ৩ কিলোমিটার পুনঃনদ খননের কাজ পায়। এসব ঠিকাদারদের সাথে কথা বলে জানা যায় প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে।

খুলনার ঠিকাদার শামিম আহমেদের কাছে নদ খনন কাজ শেষ হওয়ার আগেই ভরাট হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তিনটি লটের কাজ পেয়েছিলাম। তার মধ্যে দু’টির কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। আর একটির কাজ করতে করতে আটকে গেছে নদের তলদেশের মাটি নরম থাকায়। এ কাজে ব্যবহার করতে হবে ভাসমান যন্ত্র। সেটি এই মুহুর্তে পাওয়া না যাওয়ায় কাজটি পড়ে আছে। কিছু কিছু জায়গায় কাজ না হওয়ায় নদীর পুরোটায় ভরাট দেখাচ্ছে। তবে কাজ শেষ হলে সব ঠিক হয়ে যাবে বলে জানান এ ঠিকাদার।

যশোরের পুরাতন কসবা এলাকার রেজা এন্টারপ্রাইজের মালিক রেজার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি মাত্র তিন কিলোমিটারের খনন কাজ করেছি। সেটি বার বাজার ও চৌগাছা এলাকায়। আমি সেটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বরত ব্যক্তিদের কাজের সিডিউল অনুযায়ী বুঝিয়ে দিয়েছি। এর পরে নদ যদি ভরাট হয়ে যায় সেটি বলতে পারবে পানি উন্নয় বোর্ডের কর্মকর্তরা। এ কথা বলেই তিনি ফোনের লাইনটি বিছিন্ন করে দেন।

ঠিকানা বিহীন এম টি এন্ড এস এস কনসোর্টিয়াম ও এস টি এন্ড এম টি (জেভী) ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মালিক ইমদাদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা তিনটি লটের বার বাজার চৌগাছা এলাকায় কাজ পেয়েছিলাম। সেটি অনেক আগে শেষ করেছি। এখন যদি সেগুলো ভরা হয়ে যায় তাহলে আমাদের কিছুই করার নেই। অফিসের ঠিকানা বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি সাথে সাথে তার ফোনের লাইনটি বিছিন্ন করে দেন। পরে বার বার তার ফোনে ফোন দিলেও তিনি তার ফোনটি রিসিভ করেননি।
ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন কমিটির উপদেষ্টা ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ইকবাল কবির বলেন, জনগণের দীর্ঘ দিনের আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে ভৈরব নদ খনন পকল্পের অনুমোদন দিয়েছিল সরকার ঠিকই। নদটির সংস্কার নিয়ে যশোরের মানুষের অনেক স্বপ্ন ছিল। এ অঞ্চালের মানুষ ভেবে ছিল নদটি সংস্কার হলে নদের যৌবন ফিরে পাবে। নদটিতে আবরো নৌকা চলবে। কিন্তু সঠিকভাবে কাজ না হওয়ায় নদে নৌকা চলা তো দুরের কথা সঠিকভাবে পানির প্রবাহও চলছে না। কিছু অসাধু ঠিকাদার নাম মাত্র নদ খনন করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে জোর দাবি সরকার যেন এসব অসাধু ঠিকাদারদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। এ বিপুল পরিমানে রাষ্টীয় অর্থ খরচ করে নদ খনন একেবারেই বুমেরাং হয়ে গেছে বলে তিনি জানান।

পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ তোহিদুল ইসলামের কাছে ভৈরব খনন কাজ শেষ হওয়ার আগেই নদী ভরাট হওয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। কিভাবে কি কাজ হয়েছে সেটি আগের কর্মকর্তা প্রবীর কুমার ভাল বলতে পারবে। তবে আমি আপনার মাধ্যমে জানতে পারলাম নদী খননে ত্রুটি হচ্ছে। আমি বিষয়টি নিয়ে সব ঠিকাদারের সাথে বসবো। যদি খননে কোথাও কোন অনিয়ম দেখা যায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *