তরিকুল ইসলাম মিঠু, যশোর প্রতিবেদক: বাংলাদেশের প্রধান ও বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল। প্রতিদিন ভারত থেকে বাংলাদেশ ৫শ’র অধিক পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বন্দরের আমদানী টার্মিনালে প্রবেশ করেন।
অনুরূপভাবে কয়েক শ’ রপ্তানীবাহী ট্রাক পণ্য নিয়ে রপ্তানী টার্মিনাল হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। গত ১৫ই অক্টোবর ২০২০ থেকে বন্দরের রপ্তানীর টার্মিনালের জায়গা দখল করে গ্যারেজ তৈরি করেছেন ‘‘গ্রেট বেঙ্গল এন্টারপ্রাইজ কোম্পানী লিমিটেড” নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। চুক্তিপত্রের আইন লঙ্ঘন করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি বন্দর কর্তৃপক্ষকে বিশেষভাবে ম্যানেজ করেই এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে গত চার বছর ধরে। ফলে একদিকে যেমন বন্দরে রপ্তানী যোগ্য পণ্য নিয়ে ট্রাকগুলো রাস্তার দুই ধারে লম্বা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে রাস্তায় প্রচন্ড যানজট সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে বন্দর টার্মিনাল চার্জ বাবদ সরকার মোটা অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
অনুসন্ধানে গিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন বাংলাদেশে থেকে কয়েক’শো রপ্তানী পণ্যবাহী ট্রাক রপ্তানী টার্মিনালে অবস্থান করার কথা। কিন্তু টার্মিনালটিতে ‘গ্রেট বেঙ্গল এন্টারপ্রাইজ’নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান স্থানীয় আওমীলীগ নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে অনৈতিকভাবে ‘গ্যারেজ ও গ্যারেজের মেরামতের বিভিন্ন ধরনের উপাদান রাখায় টার্মিনালটি রপ্তানীকারকরা ব্যবহার করতে পারছেনা। ফলে যশোর-বেনাপোল সড়কের দু’ধার দিয়েই রপ্তানী ট্রাকগুলো দীর্ঘ সময় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এ কারণে রাস্তায় প্রচন্ড যানজটে সৃষ্টি হয়। যানজটের সৃষ্টির কারণে ভারতগামী পাসপোর্ট-যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। যানজট এতটাই প্রকট হয় যে, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্সের মত জরুরী সেবা প্রদানকারী বাহনগুলো জানজটে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থেকে নাকাল হতে হয়।
বন্দরের সূত্রগুলো জানিয়েছে, বন্দরের উপপরিচালক রেজাউল করিম ও তার অনুসারীরা বিশেষভাবে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে সরকারী রপ্তানি টার্মিনালে গ্যারেজ নির্মাণের অনুমতি দেন। তাই কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে দেখেও না দেখার ভান করেন। তাছাড়া বন্দরটিতে প্রতিমাসে ক্রেন-ফারক্লিপের মাধ্যমে এক শো’ থেকে দেড় শ’ হাজার মেট্রিক টন পণ্য ওঠা ও নামানোর কাজ করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী বন্দরের মালামাল লোড আনলোড করার জন্য গ্রেট বেঙ্গল এন্টারপ্রাইজের কোম্পানী লিমিটেডের ১১টি ফরক্লিপ ও ৬টি ক্রেন থাকার কথা। কিন্তু কাগজে-কলমে রয়েছে সাতটি ক্রেন ও নয়টি ফরক্লিফ। তার মধ্যে বর্তমানে দু’টি ক্রেনও তিনটি ফরক্লিপ সচল রয়েছে। বাকি সবগুলো নষ্ট হয়ে অচল রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। তাছাড়া যেগুলো সচল রয়েছে সেগুলোও নির্ধারিত ওজনের পণ্য উঠানো নামানো করাতে ব্যর্থ।
রপ্তানীকারক কামাল এন্টারপ্রাইজের প্রতিনিধি রবিউল ইসলাম রবি বলেন, রপ্তানী যোগ্য প্রতিটি ট্রাক থেকে বন্দর কতৃপক্ষ ১৮০ টাকা করে আদায় করে থাকেন। অথচ রপ্তানী টার্মিনালে কখনো রপ্তানী পন্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করতে পারে না। রপ্তানী টার্মিনাটি দীর্ঘদিন ধরে দখল করে পুরাতন নষ্ট ক্রেনও ফরক্লিপসহ তাদের গ্যারেজও স্টোর টার্মিনাল তৈরি করেছে। ফলে রপ্তানী যোগ্য পণ্যবাহী ট্রাকগুলো রপ্তানী টার্মিনালে প্রবেশ করতে না পেরে ভারতে প্রবেশের অপেক্ষায় রাস্তার দু’ধার দিয়ে দীর্ঘ সময় দাড়িয়ে থাকার কারণে প্রচন্ড যানজট সৃষ্টি হয়। যে কারণে ভারতে যাতায়াতকারী পাসপোর্ট যাত্রীরা চরম দূভোগের শিকার হয়। এমনকি জরুরী সেবার যানবাহনগুলোও যানজটে আটকে থাকতে হয়। বিষয়টি নিয়ে বন্দর পরিচালককে বার বার জানিয়েও কোন সুফল মেলেনি।
রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠানের সিএন্ডএফ এজেন্টের মালিক আশরাফুল আলম বলেন, রপ্তানীকারকরা সাধারণত পাট ও পাট জাত উৎপাদিত পণ্য ও মাছ ভারতের রপ্তানী করে থাকেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে রপ্তানী টার্মিনালটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি দখল করে রাখায় সেখানে রপ্তানী পণ্যবাহী ট্রাক রাখা সম্ভব নয়। এ কারণে রপ্তানী যোগ্য পণ্যের একদিকে যেমন নিরাপত্তা বিঘ্ন ঘটছে। অন্যদিকে রাস্তার ধারে পণ্যবাহী ট্রাকগুলে দীর্ঘ সময় থাকাতে যানজট সৃষ্টি হয়। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সরকারী টার্মিনাল ছেড়ে দিয়ে তারা তাদের নিজস্ব জায়গায় গ্যারেজ তৈরি করলে রপ্তানী কারকরা তাদের মালামাল নির্বিঘ্নে ভারতে পাঠাতে পারতো।
বিষয়টি নিয়ে বেনাপোল রপ্তানী টার্মিনালে অবস্থিত গ্রেট বেঙ্গলের ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকের পরিচয় পেয়ে কৌশলে পালিয়ে যান। পরে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেনের মুঠোফোনে সংযোগ দিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সব বন্দরের জায়গা গ্যারেজের কার্যাবলী পরিচালনা করে আসছি। বেনাপোল বন্দরেও সেভাবে কাজ করছে। তবে এই পর্যন্ত বন্দরের কেউ আমাদেরকে বাধা সৃষ্টি করেনি। তবে বন্দরে মালামাল লোড-আনলোডের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি বিকলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তার ফোনের সংযোগটি বিছিন্ন করে দেন। পরে বার বার সংযোগ দিলেও তিনি ফোনটি রিসিভ করেননি।
বেনাপোল ট্রান্সপোর্ট এজেন্সী মালিক সমিতির সভাপতি আতিকুজ্জামান সানি বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি বেনাপোল বন্দরের শুরু থেকেই নানা অনিয়ম সাথে জড়িত। একদিকে যেমন অনৈতিকভাবে বন্দরের রপ্তানি টার্মিনাল ব্যবহার করে তাদের গ্যারেজ তৈরি সরকারের মোটা অংকের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। অন্যদিকে তাদের ব্যবহার করা অধিকাংশ ক্রেন ফর ক্লিপ বছরের বেশিরভাগ সময়ই অকেজ হয়ে পড়ে থাকে। বন্দরের মালামাল লোড আনলোড করতে খুবই অসুবিধা হয়। ফলে নির্ধারিত সময়ে বন্দরের মালামাল লোড করা সম্ভব হয় না তাই দিনের পর দিন মালামাল গুলো বন্দরে পড়ে থাকে। এতে একদিকে যেমন আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি বন্দরের জায়গা দখল করাতে রাষ্টের চরম ক্ষতি হচ্ছে। বাইরে এ পরিমাণ জায়গা নিয়ে একটা গ্যারেজ তৈরি করতে হলে প্রতি মাসে তিন থেকে চার লাখ টাকা ভাড়া গুনতে হতো বলেও তিনি জানান।
বিষয়টি নিয়ে বন্দরের ভারপ্রাপ্ত উপ পরিচালক রাশেদুল নাজির সজীবের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চুক্তিপত্র বন্দরের জায়গা ব্যবহার অথবা না ব্যবহারের কোন বিষয়েই উল্লেখ নেই। তাই তিনি এসব বিষয় না লিখে প্রয়োজনে তাদের অধিকাংশ ইকুপমেন্টের কার্যক্ষমতা নেই ও নষ্টের বিষয়টি নিয়ে লেখার পরামর্শ দেন তিনি।